ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হচ্ছে দোয়া। ‘দোয়া’ আরবি শব্দ, অর্থ হচ্ছে- চাওয়া, প্রার্থনা করা, নিবেদন করা। দোয়ার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নিকট আকুতি-মিনতি জানায়, তার মনের চাওয়া-পাওয়া আল্লাহর কাছে প্রকাশ করে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কুরআনে এরশাদ করেন, ‘তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেবো।’ (সূরা মু’মিন/গাফির, আয়াত ৬০)্ হজরত নুমান ইবন বাশীর রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা অত্যধিক লজ্জাশীল ও দয়ালু। যখন কোন বান্দা তাঁর কাছে দুই হাত তুলে প্রার্থনা করে তখন তিনি তাকে শূন্যহাতে বা তাকে নিরাশ করে ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন।’
মুমিনের প্রতিটি কাজই চমৎকার, সুবিন্যস্ত ও সুনিয়ন্ত্রিত। একজন মুসলিম কিভাবে আল্লাহর কাছে কোনো কিছুু চাইবে, কোন সময়টা চাওয়া-পাওয়ার জন্য উপযুক্ত, কোন জায়গা নির্বাচন করে আল্লাহকে ডাকলে দোয়া কবুল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা বেশি থাকে, কুরআন হাদিসে সেসব দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দোয়া কবুল হওয়ার বিশেষ কিছু সময় ও স্থান কুরআন-হাদিসের আলোকে তুলে ধরা হলোÑ
০১. ফরজ সালাতের পর : আবু উমামাহ রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা:-কে জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! কোন সময়ের দোয়া বেশি গ্রহণযোগ্য হয়? তিনি বললেন, ‘শেষ রাতের মাঝের দোয়া এবং ফরজ সালাতের পরের দোয়া।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ, হা. ৯৬৮)।
০২. আজান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময় : আনাস ইবনে মালিক রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেন, ‘আজান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়ের দোয়া কখনো প্রত্যাখ্যাত হয় না।’ (আবু দাউদ, হা.৫২১)।
০৩. রাতের শেষ ভাগে : আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেন, ‘প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশ বাকি থাকতে আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন। অতঃপর তিনি বলেন, আমার কাছে যে দোয়া করবে তার দোয়া আমি কবুল করব। যে ব্যক্তি আমার নিকট (কিছু) প্রার্থনা করবে আমি তাকে তা দান করব। যে ব্যক্তি আমার নিকট ক্ষমা চাইবে আমি তাকে ক্ষমা করে দেবো।’ (বুখারি, হা.১১৪৫)।
০৪. জুমার দিন : আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল জুমার দিন সম্পর্কে অলোচনা করেন এবং বলেন, ‘এ দিনে এমন একটি মুহূর্ত রয়েছে, যে কোনো মুসলিম বান্দা যদি এ সময় সালাতে দাঁড়িয়ে আল্লাহর নিকট কিছু প্রার্থনা করেন, তবে তিনি তাকে তা অবশ্যই দিয়ে থাকেন এবং তিনি হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে বুঝিয়ে দিলেন যে, সে মুহূর্তটি খুবই সংক্ষিপ্ত।’ (বুখারি : ৯৩৫)।
সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, ‘জুমার দিন দোয়া কবুলের চূড়ান্ত সময় হচ্ছে, ইমামের মিম্বারে বসা হতে সালাত শেষ হওয়া পর্যন্ত।’ (মুসলিম : ১৮৬০) অন্য বর্ণনায় আছে, ‘আসর হতে মাগরিব পর্যন্ত।’ (আবু দাউদ: ১০৪৮)।
০৫. সিয়াম অবস্থায় : আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া রদ হয় না। ন্যায়পরায়ণ শাসক, রোজাদার যতক্ষণ না ইফতার করে এবং মাজলুমের দোয়া। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দোয়া মেঘমালার উপরে তুলে নিবেন এবং তার জন্য আসমানের দ্বারসমূহ খুলে দেয়া হবে এবং আল্লাহ বলবেন, আমার মর্যাদার কসম! আমি অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করব, একটু বিলম্ব হলেও।’ (ইবনে মাজাহ)।
০৬. যুদ্ধের মাঠে শত্রুর সাথে মোকাবেলার সময় : সাহল ইবনু সা’দ রা: হতে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেনে, ‘দুই সময়ের দোয়া প্রত্যাখ্যাত হয় না বা খুব কমই প্রত্যাখ্যাত হয়। আজানের সময়ের দোয়া এবং যুদ্ধের সময়ের দোয়া, যখন পরস্পর কাটাকাটি, মারামারি আরম্ভ হয়ে যায়।’ (আবু দাউদ)।
০৭. সিজদায় : ইবনে আব্বাস রা: হতে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেনে, ‘সাবধান! আমাকে রুকুু-সিজদায় কুরআন তিলাওয়াত করতে নিষেধ করা হয়েছে। তাই তোমরা রুকুতে তোমাদের রবের মহিমা বর্ণনা করো। আর সিজদায় অতি মনোযোগের সাথে দোয়া করবে। আশা করা যায়, তোমাদের দোয়া কবুল করা হবে। (মুসলিম)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘বান্দা সিজদার সময়ে মহান আল্লাহর সর্বাধিক নৈকট্য লাভ করে। কাজেই এ সময় তোমরা অধিক পরিমাণে দোয়া পাঠ করবে।” (মুসলিম)।্
০৮. লাইলাতুল কদরে : কদরের রাত্রি দোয়া কবুলের অন্যতম সময়। সহিহ হাদিসে এসেছে, রাসূল সা: ইবাদতের জন্য লাইলাতুল কদরকে খুঁজতে বলতেন এবং নিজে লাইলাতুল কদরে সিজদা করতেন।’ (বুখারি)।
০৯. আরাফার মাঠে : উসামা ইবনে যায়েদ রা: বলেন, ‘আমি আরাফার মাঠে রাসূল সা:-এর সাওয়ারীর পিছনে ছিলাম, তিনি সেখানে দু’হাত তুলে দোয়া করলেন।’ (নাসাঈ) আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেন, ‘মহামহিমান্বিত আল্লাহ আরাফাতের দিন জাহান্নাম থেকে যত অধিকসংখ্যক বান্দাকে নাজাত দেন, অন্য কোনো দিন এত অধিক সংখ্যক বান্দাকে নাজাত দেন না। মহাপ্রতাপশালী আল্লাহ এ দিন (বান্দার) নিকটবর্তী হন, অতঃপর তাদের সম্পর্কে ফেরেশতাদের নিকট গৌরব করে বলেন, তারা কী চায়?’(মুসলিম)।
১০. তিন শ্রেণীর লোকের দোয়া : আবু হুরায়রা রা: হতে বর্ণিত, নবী সা: বলেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া নিঃসন্দেহে কবুল হয়। ১. পিতামাতার দোয়া ২. মুসাফিরের দোয়া ৩. মাজলুমের দোয়া।’ (আবু দাউদ)। কুরআন ও হাদিসের দৃষ্টিকোণ থেকে আশা করা যায়, উপরোক্ত স্থান ও সময়গুলো দোয়া কবুলের জন্য প্রাসঙ্গিক। দোয়া কবুল হওয়ার কার্যকরী মুহূর্ত। আমাদের উচিত উক্ত স্থান, সময় ও মুহূর্তগুলোকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো। মনে রাখতে হবে, দোয়া কবুলের পূর্বশর্ত হলো হালাল খাবার।
লেখক : এমফিল গবেষক, প্রাবন্ধিক