দুই বছরের বেশি সময় ধরে দেশে করোনা মহামারী চলছে। বিশ্বজুড়ে বিপর্যস্ত অর্থনীতি। বন্ধ অনেক শিল্প-প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা-বাণিজ্য। সরকারি ছাড়া কয়েক বছর ধরে দেশে কোনো ধরনের বিনিয়োগ নেই। মহামারীতে থমকে গেছে শ্রমবাজার। চাকরি হারিয়ে বাড়ছে নতুন বেকারত্ব। অন্যদিকে, সরকারি ও বেসরকারি খাতে দীর্ঘসময় ধরে নেই নতুন করে কোনো নিয়োগ। সব মিলিয়ে নতুন করে বেকারত্ব বাড়ছে প্রতি বছর। বয়স তো থেমে থাকছে না, এ অবস্থায় হতাশায় ভুগছে যুবসমাজ।
দেশের শ্রমবাজারে বছরে প্রায় ১০ লাখের মতো নতুন শ্রমশক্তির অন্তর্ভুক্তি হচ্ছে। আর দেশে যে পরিমাণ চাকরির সুযোগ আছে, তাতে প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ৪৭ শতাংশ গ্র্যাজুয়েটের চাকরি পাওয়ার সুযোগ নেই বলে শ্রমবাজারে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের মতে, এখন প্রয়োজন ধাপে ধাপে অনলাইনে চাকরির পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। আর সরকারের উচিত হবে আগামী দিনে আন-এমপ্লয়মেন্ট বীমার চিন্তা-ভাবনা করা।
সর্বশেষ ২০১৭ সালের বিবিএস শ্রমশক্তি জরিপের তথ্যানুযায়ী, দেশে ২৭ লাখ মানুষ কোনো কাজ করে না। অর্থাৎ এরা বেকার। শতাংশ হিসাবে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ। এছাড়া এ বছরের ৩০ জানুয়ারি প্রকাশিত গত ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমানের মূল্যায়নে সারা দেশে ১১টি শিক্ষা বোর্ড থেকে ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ জন শিক্ষার্থী পাস করেছে। এর আগের বছর ২০১৯ সালে মোট ১৩ লাখ ৩৬ হাজার ৬২৯ জন শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে এবং তাদের মধ্যে ৯ লাখ ৮৮ হাজার ১৭২ জন পাস করেছে। অর্থাৎ দেশের শ্রমবাজারে প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখের মতো জনশক্তি নতুন করে যুক্ত হচ্ছে। বিবিএস সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ এর হিসাব বলছে, দেশে শ্রমশক্তির মোট পরিমাণ পাঁচ কোটি ৬৭ লাখ। এর মধ্যে কাজ করছে পাঁচ কোটি ৫১ লাখ ৮০ হাজার জন। এর অর্থ বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৮০ হাজার।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, গত ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে ১৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৬৮টি অনুমোদিত পদ রয়েছে। এসবের বিপরীতে ১৫ লাখ ৪ হাজার ৯১৩ জন বর্তমানে কর্মরত। শূন্য আছে ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৩৩৮টি পদ। এছাড়া প্রতি মাসেই অবসরে যাচ্ছে প্রজাতন্ত্রের জনবল। বর্তমানে শূন্য পদের মধ্যে ৪৬ হাজার ৬০৩টি প্রথম শ্রেণীর, ৩৯ হাজার ২৮টি দ্বিতীয় শ্রেণীর, এক লাখ ৯৫ হাজার ৯০২টি তৃতীয় শ্রেণীর এবং ৯৯ হাজার ৪২২টি চতুর্থ শ্রেণীর।
করোনা মহামারীর মধ্যে সেসব পদ পূরণের কাজটি থমকে গেছে। গত বছর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটির সময় সব ধরনের নিয়োগ বন্ধ ছিল। পরে কিছু প্রক্রিয়া শুরু হলেও সংখ্যায় তা খুবই সামান্য। মহামারীর কারণে সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে চাকরির বাজার। নতুন নিয়োগ নেই অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। গত দেড় বছরে একটি মাত্র বিসিএস প্রিলিমিনারি ছাড়া আর কোনো চাকরির পরীক্ষার সুযোগ আসেনি। বেসরকারি চাকরিতে নতুন নিয়োগ তো দূরের কথা পুরনোরাই চাকরি হারাচ্ছেন। যারা আছেন, তারাও প্রতিনিয়ত চাকরি হারানোর শঙ্কায় থাকেন।9
এদিকে, পিএসসি করোনা মহামারীতে সবধরনের পরীক্ষা ও নিয়োগ বন্ধ রেখেছে। সর্বশেষ ১২ এপ্রিল সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নন-ক্যাডার চাকরির আবেদন কার্যক্রমও স্থগিত করেছে সরকারি কর্মকমিশন। এছাড়া গত ৩১ মার্চ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ১০ গ্রেডের সিনিয়র স্টাফ নার্স ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের ফটো টেকনিশিয়ান পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। করোনাকালে নতুন করে ব্যাপক বেকারত্ব বৃদ্ধিতে একটা উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে। এর মধ্যে সরকারি চাকরির নিয়োগ ও নির্বাচনী পরীক্ষা স্থগিত হয়ে থাকায় তরুণ প্রজন্মের জন্য বড় দুশ্চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগপ্রক্রিয়া স্থবির হয়ে থাকায় অনেক চাকরিপ্রার্থী তরুণ-তরুণীরই বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলে গত ৩১ মার্চ পিএসসির অধীন সব পরীক্ষা কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। দুই মাস সেই স্থগিত অবস্থাতেই আছে সেই কার্যক্রম। যদিও মাঝে সাড়ে চার হাজার চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগের কার্যক্রম সমাপ্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু পরে তা থেমে গেছে। গত ২৩ মে থেকে ৪২তম (বিশেষ) বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল পিএসসি। লকডাউনের কারণে গত ১৮ মে ৪২তম বিসিএসের ভাইভা পরীক্ষা স্থগিত করতে হয়। মহামারী করোনার কারণে গত ৩১ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদফতরের সিনিয়র স্টাফ নার্স পদের লিখিত পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। দশম গ্রেডের এ পদের লিখিত পরীক্ষা গত ১০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু স্থগিত হওয়ার পর আবার ৯ মে এই পরীক্ষা নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু সরকার লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানোর কারণে সেটিও স্থগিত করা হয়েছে। তবে লকডাউন শেষ হওয়ার পরপরই পরীক্ষা গ্রহণ শুরু করা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
আর করোনাকালে বেকারত্বের হিসাব দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীভুক্ত সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)। তাদের হিসেবে, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর কারণে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে (এমএসএমই) কর্মরত ৩৭ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছেন। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, করোনা মহামারীর কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম। করোনা মহামারীতে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিগুণ হয়েছে। আইএলওর হিসাবে, এই তরুণদের সবাই পূর্ণকালীন কাজে নিয়োজিত থাকলে বাংলাদেশে করোনাকালে বেকারের সংখ্যা হতো অন্তত ১৬ লাখ ৭৫ হাজার জন।
এদিকে বেসরকারি শিক্ষকদের নিয়োগ দেয় বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ-এনটিআরসিএ সর্বশেষ ৫৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগের জন্য আবেদন গ্রহণ করেছে। এতে আশার আলো দেখেছিলেন প্রায় ৮০ লাখের মতো আবেদনকারী। কিন্তু উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক সেই নিয়োগও আটকে আছে।
সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের তথ্য বলছে, দেশে এসএসসি থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের এক-তৃতীয়াংশ বেকার। আর প্রতি বছর চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন ২৬ লাখ তরুণ। তাদের মধ্যে আবার সর্বোচ্চ ২০ লাখ তরুণের চাকরির সংস্থান হলেও বাকিরা বেকার থাকেন। দেশের সরকারি খাত সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থানে সক্ষম। বাকি ৯৬ শতাংশ এখনো বেসরকারি, ব্যক্তিমালিকানা বা আত্মকর্মসংস্থানে জড়িত।
নিয়োগের ব্যাপারে পিএসসির চেয়ারম্যান মো: সোহরাব হোসাইনের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, পরীক্ষা গ্রহণের ব্যাপারে পিএসসির আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। কিন্তু মহামারীর কারণে আমাদের কিছুই করার নেই। পরিস্থিতি ভালো না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন, করোনার দ্বিতীয় দফার ঢেউ সব কিছুকে স্থবির করেছে। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেই কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনা আছে।
এ ব্যাপারে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের দেশে আন-এমপ্লয়মেন্ট ইন্স্যুরেন্স বলে তো কিছু নেই, যেটা উন্নত দেশগুলোতে আছে। সেটার চিন্তা করা যেতে পারে। তবে সেটা বাস্তবায়ন করা তো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। খুব তাড়াতাড়ি এই সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, সরকার সিভিল সার্ভিস পরীক্ষাগুলোকে অনলাইন করতে পারে। সেটার মাধ্যমেও কিছুটা চাকরির ব্যবস্থা করা সম্ভব হতে পারে। তবে সেটাও খুব একটা বড় সংখ্যা হবে না। তিনি বলেন, সরকারের যখন কোনো জায়গাতে শূন্য পদ থাকে তখন সরকার পিএসসিকে বলে আমার এতগুলো লোক দরকার। তুমি নিয়োগের ব্যবস্থা কর। পিএসসি নিজের থেকে তো কাউকে চাকরি দেয় না। তিনি বলেন, এখন তো সব কিছুই অনলাইন হচ্ছে। তাদের উচিত হবে ধাপে ধাপে অনলাইনে পরীক্ষার ব্যবস্থা করে রিভাইভ করা।(নয়াদিগন্ত)