রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লকডাউন (অবরুদ্ধ ব্যবস্থা) করার ব্যাপারে অস্পষ্টতা দেখা দিয়েছে। কোন এলাকায় লকডাউন করা হবে, তা এখনো পরিষ্কার না। লকডাউন কার্যকর করার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও শেষ হয়নি। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, করোনা প্রতিরোধে আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না।
লকডাউন বিষয়ে সরকারের মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতা কাজ করছে। গতকাল সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক আদেশে বলা হয়, নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিবেচনায় লাল (উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ) ও হলুদ (মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ) এলাকায় সাধারণ ছুটি থাকবে। বিকেলে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বলা হয়, ছুটি থাকবে শুধু লাল এলাকায়।
১৫ মে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে রাজধানীসহ দেশের বড় শহর এলাকায় লকডাউন করার পরামর্শ দিয়েছিল পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজরি কমিটি। প্রায় এক মাস পর ১১ জুন লকডাউন নিয়ে কাজ করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে প্রধান করে ১৩ সদস্যের কেন্দ্রীয় কারিগরি গ্রুপ করা হয়েছে। গ্রুপটি রাজধানীর ৪৫টি এলাকাকে লাল এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
গতকাল ধানমন্ডির একজন বাসিন্দা প্রথম আলোতে ফোন করে জানতে চেয়েছেন, পুরো ধানমন্ডি এলাকা লকডাউন হবে কি না, হলে কবে থেকে? যে ৪৫টি এলাকার নাম এসেছে, সেসব এলাকায় বসবাসকারী অনেকের মধ্যেই এ প্রশ্ন আছে। কেন্দ্রীয় কারিগরি গ্রুপের সদস্য ও রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছোট ছোট এলাকায় লকডাউন করা হবে। ঠিক কবে নাগাদ লকডাউন শুরু হবে, তা বলা যাচ্ছে না। আমরা এখন ম্যাপিংয়ের কাজ করছি।’
করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে এর আগেও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় লকডাউন করেছিল সরকার। রাজধানীর টোলারবাগে বা মাদারীপুর জেলার শিবচর এলাকায় লকডাউন করে সংক্রমণ প্রতিরোধে সফলতা পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু গত তিন মাসে করোনা প্রতিরোধে আর কোনো বড় উদ্যোগ দেখা যায়নি। ২৪ মার্চ থেকে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে কয়েক দফায় তা বাড়িয়েছিল। এসব পদক্ষেপ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারেনি। এখন প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার ব্যক্তি সংক্রমিত বলে শনাক্ত হচ্ছে। নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়লে শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যাও বাড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। সংক্রমণ কমে পরিস্থিতি কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে, তা কেউ বলতে পারছে না।
বর্তমানের লকডাউন উদ্যোগ ছাড়া সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা সরকারের আর কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ছে না। তবে এ ক্ষেত্রে যে তথ্য ব্যবহার করা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের দেওয়া মতামত পুরোপুরি না মেনেই কাজ শুরু হতে যাচ্ছে।
লকডাউন নিয়ে কথা হলেও বাস্তবায়ন নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। এখনো এলাকা চিহ্নিত করার কাজ চলছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সঠিক পরিকল্পনামাফিক কাজ না করলে এলাকাবাসীই লকডাউনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে—এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তথ্য বিভ্রাট
যেসব এলাকায় জনসংখ্যার অনুপাতে সংক্রমিত মানুষ বেশি, সেসব এলাকায় ঝুঁকিও বেশি। প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে ৬০ জন সংক্রমিত থাকলে সেই এলাকাকে লাল তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ ক্ষেত্রে দুটি প্রশ্ন তুলেছেন। প্রথমত ঢাকা শহরে কোন এলাকায় কত মানুষ বাস করে, তার সঠিক পরিসংখ্যান সরকারি কোনো দপ্তরে নেই। পরিসংখ্যান ব্যুরো যে তথ্য দেয়, প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। প্রতিটি এলাকায় ভোটারের সংখ্যা থাকে, বাস্তবে ভোটারের চেয়ে মানুষ বেশি।
এ বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে লকডাউন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পরামর্শক প্রথম আলোকে বলেন, পরিসংখ্যান ব্যুরো ও স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনারদের কাছ থেকে জনসংখ্যার তথ্য পাওয়া যাবে, যা মোটামুটি সঠিক বলে ধরে নেওয়া যাবে।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা শহরের প্রতিটি এলাকা ধরে জনসংখ্যার এই হিসাব এখনো বের করেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা কেন্দ্রীয় কারিগরি গ্রুপ। কেন্দ্রীয় কারিগরি গ্রুপ মূলত জোর দিয়েছে শনাক্তকৃত মানুষের সংখ্যার ওপর। এই তথ্যের প্রধান সূত্র আইইডিসিআর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিদিন অন্যান্য পরিসংখ্যানের সঙ্গে করোনায় নতুন ও মোট আক্রান্তের তথ্য প্রকাশ করে। আইইডিসিআরও তাদের ওয়েবসাইটে আক্রান্তের তথ্য প্রকাশ করে। আইইডিসিআর ঢাকা শহরের তথ্য বিস্তারিত দেওয়ার পাশাপাশি আট বিভাগের প্রতিটি জেলার তথ্য দেয়। সেই তথ্যে ত্রুটি আছে। তথ্যের ত্রুটি নিয়ে দুই মাস আগেও প্রথম আলোসহ একাধিক গণমাধ্যম প্রশ্ন তুলেছিল। কিন্তু বিষয়টি আমলে নেয়নি আইইডিসিআর।
আইইডিসিআরের ১৩ জুনের তথ্যে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে মোট আক্রান্ত ২৩ হাজার ৩৯৯ জন। পাশাপাশি রাজধানীর ২২২টি এলাকার তথ্য আলাদা করে দিয়েছে। এসব এলাকার আক্রান্ত ব্যক্তির মোট সংখ্যা ১৩ হাজার ১৫৬। অর্থাৎ ১০ হাজারের বেশি মানুষের হিসাবে গোলমাল আছে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে ১৩ জুন সারা দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৮৪ হাজার ৩৭৯। আইইডিসিআর বলছে, আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪৯ হাজার ৯৯৯। অর্থাৎ আক্রান্তের সংখ্যায় পার্থক্য প্রায় ৩৪ হাজার। এই তথ্যের ভিত্তিতে এলাকা লাল, হলুদ বা সবুজ চিহ্নিত করে লকডাউন কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে।
অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, নমুনা সংগ্রহের সময় সঠিকভাবে ঠিকানা না নেওয়ার কারণে তথ্যে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবে সেই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে।
নজর পূর্ব রাজাবাজারে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরামর্শ ও সহায়তায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজার এলাকায় পরীক্ষামূলক লকডাউন চালু করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, কোনো এলাকায় লকডাউন সফল করতে হলে ১২টি বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। এর মধ্যে আছে: স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্তকরণ, ঝুঁকিবিষয়ক যোগাযোগ, রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা, শনাক্তকৃত ব্যক্তিকে আইসোলেশনে (বিচ্ছিন্নকরণ) নেওয়া, কনট্যাক্ট ট্রেসিং (আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা লোক খুঁজে বের করা), খাদ্য ও সামাজিক সহায়তা, ১০০ শতাংশ নাগরিকের মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করা, সবাইকে হাত ধোয়ায় উদ্বুদ্ধ করা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, সঠিক চিকিৎসা ও মৃত্যু শূন্যে নামিয়ে আনা, সার্বক্ষণিক নজরদারি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা।
লকডাউন কার্যকর করতে পূর্ব রাজাবাজারে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে প্রধান করে ৯ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। ১০ জুন সংক্রমণ প্রতিরোধে এখানে কাজ শুরু হয়। তবে এর আগে এখানে কত রোগী শনাক্ত হয়েছিল, তা নিয়েও বিভ্রান্তি আছে। গতকাল বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে আইইডিসিআরে যোগাযোগ করতে বলা হয়। আইইডিসিআরের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছিল, রাজাবাজারে আক্রান্ত ছিল ২৯ জন। রাজাবাজার অর্থ পূর্ব ও পশ্চিম রাজাবাজার। পূর্ব রাজাবাজারের সংক্রমণের পৃথক তথ্য পাওয়া যায়নি।
ব্যবস্থাপনার সুবিধার জন্য পূর্ব রাজাবাজারকে বেছে নেওয়া হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় কারিগরি গ্রুপের একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেছেন। তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় কাজগুলো করে সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে কি না, তা দেখা দরকার। এই এলাকায় সম্ভাব্য সব কাজই করা যাবে। তবে আরেকজন সদস্য বলেছেন, একটু জটিল বা তুলনামূলকভাবে বড় এলাকায় প্রাথমিকভাবে কাজটিহওয়া দরকার ছিল। পূর্ব রাজাবাজারের সফলতা অপেক্ষাকৃত বড় ও জটিল জায়গায় প্রয়োগ করা যাবে কি না, সেই সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
কী হতে যাচ্ছে
রাজধানীর যে ৪৫টি এলাকাকে লাল এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলোর পুরোটা ধরে লকডাউন হবে না। লকডাউন হবে ছোট ছোট এলাকা ধরে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ছোট ছোট কোন কোন এলাকায় লকডাউন হবে তা নিয়ে কাজ চলছে। সেই তালিকা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হবে। এরপর লকডাউন শুরু হবে। তবে সারা ঢাকা শহরে একসঙ্গে কাজটি হবে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিরএকজন সদস্য বলেছেন, খুব ছোট এলাকায় লকডাউন করলে সংক্রমণ প্রতিরোধে সফলতা আসবে না। দ্বিতীয়ত পুরো ঢাকা শহরে একই সঙ্গে লকডাউন করতে হবে।
তবে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ হবে কনট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের ব্যাপারে। আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, পূর্ব রাজাবাজারে আইইডিসিআর কাজটি করছে। এলাকার ১৮ জন স্বেচ্ছাসেবককে এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সব জায়গায় স্থানীয় মানুষদের কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হবে।
অন্য একটি সূত্র বলছে, মুঠোফোন ব্যবহার করে কনট্যাক্ট ট্রেসিং করার কথাও ভাবছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরামর্শকেরা এ ব্যাপারে কোনো পরামর্শ দেননি।
জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এখনো যদি করি, করব বলে সময় নষ্ট করি, তা হলে ঘোর অন্ধকার বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষা করে আছে।’