বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একদল শিক্ষক-শিক্ষার্থীর উদ্ভাবিত ‘অক্সিজেট’ নামের যন্ত্রটির উৎপাদন ও ব্যবহারের জন্য ‘সীমিত’ অনুমোদন দিয়েছে সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর (ডিজিডিএ)। প্রাথমিকভাবে যন্ত্রটির ২০০ ইউনিট উৎপাদন করে তা ব্যবহার করা যাবে। ফলাফল পর্যবেক্ষণ করে বড় আকারে উৎপাদন ও ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হতে পারে।
ডিজিডিএর উপপরিচালক মো. সালাউদ্দিন আজ বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে এসব তথ্য জানান। এ যন্ত্রের মাধ্যমে তীব্র শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীদেরও হাসপাতালের সাধারণ বেডে রেখেই উচ্চমাত্রায় অক্সিজেন-সহায়তা দেওয়া যায় বলে জানিয়েছেন উদ্ভাবকেরা।
মো. সালাউদ্দিন বলেন, ‘জরুরি ব্যবহারের জন্য স্বল্পসংখ্যক অক্সিজেটের (২০০ ইউনিট) সীমিত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহারের জন্য। এটি অনেকটা ট্রায়ালের অংশ। অক্সিজেটের পোস্ট–মার্কেটিং ভিজিল্যান্স (বিপণন-পরবর্তী সতর্কতা) করতে হবে। প্রত্যেক রোগীর তথ্য রাখতে হবে। দেখতে হবে যে এতে রোগীর উপকার হচ্ছে কি না, কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে কি না কিংবা কোনো ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে কি না। যন্ত্রটি আরও উন্নত করা যায় কি না, তাও দেখতে হবে। এই সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে বড় আকারে যন্ত্রটির অনুমোদন দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।’
চিকিৎসা ও উদ্ভাবনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের হাসপাতালগুলোর সাধারণ বেডে রোগীকে প্রতি মিনিটে সর্বোচ্চ ১৫ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন দেওয়া যায়। তার বেশি অক্সিজেনের দরকার হলে ‘হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা’ লাগে। কিংবা রোগীকে আইসিইউতে নিতে হয়। কিন্তু বিশেষ ওই ক্যানুলা ও আইসিইউ উভয়ের সংকট থাকায় অনেক রোগীকে পর্যাপ্ত অক্সিজেন দেওয়া সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে অক্সিজেটের ব্যবহার বেশ কার্যকর বলে জানিয়েছেন উদ্ভাবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, এ যন্ত্রের মাধ্যমে সাধারণ বেডে রেখেই রোগীকে ৬০ লিটার পর্যন্ত উচ্চমাত্রার অক্সিজেন দেওয়া যায়।
চিকিৎসা ও উদ্ভাবনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, রোগীদের উচ্চমাত্রায় অক্সিজেন দেওয়ার জন্য বাজারে যেসব সিপ্যাপ ডিভাইস আছে, সেগুলোর দাম ১ লাখ বা তার চেয়ে বেশি। হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলার দাম ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা। অন্যদিকে অক্সিজেটের পুরো সেটআপ মিলিয়ে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার মতো খরচ পড়ে। বাণিজ্যিক উৎপাদনে গেলে এ খরচ আরও কমে আসবে বলে দাবি উদ্ভাবকদের। তা ছাড়া অক্সিজেটের ব্যবহারকৌশল সহজ। এটি সহজে যেকোনো জায়গায় বহনযোগ্য।
উদ্ভাবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, হাসপাতালের সাধারণ বেডে ১৫ লিটারের অক্সিজেন ফ্লো-মিটার থাকে। এটি দিয়েই মাস্কের মাধ্যমে অক্সিজেন দেওয়া হয়। অক্সিজেট থাকলে একটির জায়গায় দুটি ফ্লো-মিটার ব্যবহার করা যাবে। একটি ১৫ লিটারের, অন্যটি ৫০ লিটারের। অক্সিজেট নিম্নচাপ তৈরি করে পরিবেশ থেকে আরও বাতাস নেয়। দ্বিতীয় সংযোগে ৫০ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন থাকে, যাতে প্রয়োজনে মোট ৬০ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন দেওয়া যায়। অক্সিজেটে যে মাস্ক ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটি একটি নন-ভেন্টেড সিপ্যাপ মাস্ক। এটি খুব দৃঢ়ভাবে মুখে আটকানো থাকে, যেন বাতাস বের না হয়ে যেতে পারে। সবশেষে একটি পিপ ভাল্ভ যুক্ত করে রোগীর জন্য অক্সিজেনের চাপ কত হবে, তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অক্সিজেট নামের এ যন্ত্র বিদ্যুৎ ছাড়াই কাজ করে।
দেশে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর গত বছরের মে-জুন মাসের দিকে অক্সিজেট নিয়ে কাজ শুরু করেন বুয়েটের একদল শিক্ষক-শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়টির জৈব চিকিৎসা প্রকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তওফিক হাসান তাঁর চার শিক্ষার্থীকে সঙ্গে নিয়ে কাজটি শুরু করেন। চার শিক্ষার্থী হলেন মীমনুর রশিদ, ফারহান মুহিব, কায়সার আহমেদ ও কাওসার আহমেদ। পরে বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁদের সহযোগিতা করেন জৈব চিকিৎসা প্রকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ তারিক আরাফাত, সহকারী অধ্যাপক জাহিদ ফেরদৌস ও সাঈদুর রহমান।
অক্সিজেট উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দেওয়া বুয়েট শিক্ষক তওফিক হাসান প্রথম আলোকে বলেন, অক্সিজেটকে ১৫ লিটার অক্সিজেন ফ্লো-মিটারের সঙ্গে যুক্ত করলে পরিবেশ থেকে আরও বাতাস যুক্ত করে ৬০ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেনযুক্ত বাতাস তৈরি করতে পারে। হাসপাতালগুলোয় অক্সিজেটের ব্যবহার শুরু হলে আইসিইউ সেবার জন্য রোগীদের চাপ কমবে।
ঔষধ প্রশাসনের কাছ থেকে সীমিত অনুমোদন পাওয়ার বিষয়ে তওফিক হাসান বলেন, ‘আমরা বুয়েটের পক্ষ থেকে অক্সিজেটের অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছিলাম। স্বল্প পরিসরে অনুমোদন পেয়েছি। কোনো উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের অধীনে আবেদনটি করা হলে এ পরিমাণ আরও বাড়ত। অক্সিজেটের বড় আকারের অনুমোদনের জন্য আমাদের আরও কিছু পর্যায় অতিক্রম করতে হবে।’
বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের অনুমোদন নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকদের সহায়তায় অক্সিজেটের তিন ধাপের ট্রায়াল চলতি মাসেই শেষ করে উদ্ভাবক দল। করোনা চিকিৎসায় যন্ত্রটি ব্যবহারের জন্য ডিজিডিএর অনুমোদনের দরকার পড়ে। ডিজিডিএর কিছু নিয়মকানুন ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যন্ত্রটির বাণিজ্যিক উৎপাদনে রাজি না হওয়ায় অক্সিজেটের অনুমোদন নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। এর মধ্যে একজন আইনজীবী অক্সিজেটের অনুমোদনের বিষয়টি উচ্চ আদালতের নজরে আনেন। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনার পরামর্শ দেন আদালত। এমন প্রেক্ষাপটে অক্সিজেটের ‘সীমিত’ অনুমোদন মিলল।