ইসলামী ব্যাংকিং : প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যাবস্থার বিপরীত হচ্ছে ইসলামী ব্যাংকিং(Islami Banking)। ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ে এক সময় মানুষ কল্পনা করত কিন্তু যা এখন বাস্তবতা ।বিংশ ও একুশ শতকে পৃথিবীর অথর্নীতি বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হওয়ার পর সকলের নিকট নিরাপদ,যুগউপযোগী ও সবার্ধুনিক ব্যাংকিং হিসাবে সকলের নিকট ইসলামী ব্যাংকিং গ্রহনযোগ্য হিসাবে স্বকৃতি পেয়েছে ।এখানে মানুষের আমানত যেমন নিরাপদ তেমনি ব্যাংকের বিনিয়োগ নিরাপদ ।
বিশ শতকের কতিপয় ইসলামী মনীষী ও অথর্নীতিবিদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও গবেষণার ফসল হিসাবে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা বাস্তবতা ও সাফল্য লাভ করেছে ।পবিত্র কুরআন শরীফের অথর্নীতি বিষয়ক আয়াতগুলোর বাস্তবরূপ দেওয়ার মাধ্যমে মানুষের কল্যাণের জন্য তারা এই কাজ করেছেন ।ষাটের দশকে মিসরে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, নানা চড়াই উৎরাই অতিক্রম করে তা ধীরে ধীরে আজকের এই মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা লাভ করে । যুগের ও সময়ের চাহিদার আলোকে এটা আধুনিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা পাবে। সতরের দশকে মুসলমানের আর্ন্তজাতিক সংগঠন “ ইসলামী সম্মেলন সংস্থা” (OIC)শরীয়াহভিত্তিক ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে বিশেষ করে মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার দ্বার উম্মেচন ঘটে । ১৯৭৫ সালে “ ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক” তার যাত্রা শুরু করলে ইসলামী ব্যাংকিং কাযর্ক্রম ব্যাপকতা ও প্রসার লাভ করার সুযোগ সৃষ্টি হয় । আশি ও নব্বই দশেকে অনেক গুলো দেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করার ফলে এর অগ্রযাত্রা দ্রুত প্রসার লাভ করে।ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সফলতা দেখে মুসলিম দেশের বাহিরে, অনেক অমুসলিম দেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে । ইসলামী শরীয়ার আলোকে পরিচালিত ব্যাংকিং তার শ্রেষ্ঠত্ব সকলের নিকট প্রমাণ করে দিয়েছে ।এটি হচ্ছে উন্নতর ও আধুনিক ব্যাংকিং ব্যাবস্থা ।ইসলামী ব্যাংকিং এর মাধ্যমে অথর্নীতিতে যেমন ভারসাম্য সৃষ্টি হয়, তেমনি সম্পদের সুসম বন্টন হয় আবার কল্যাণধর্মী কাযর্ক্রম বিস্তর লাভ করে ।
ইসলামী ব্যাংকের সংঞ্জা : ইসলামী ব্যাংকিং একটি আথির্ক প্রতিষ্ঠান ।এ প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হচ্ছে, ব্যাংকিং জগতে ইসলামী শরীয়াহ আলোকে অথর্নীতি বাস্তবায়ন করা । অথর্নীতিতে সূদ বজর্ন করে সূদবিহীন ব্যাংকিং ব্যবস্থা কায়েম করা । এই ক্ষেত্রে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) এর সংঞ্জা সকলের নিকট গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছে । সংঞ্জাটি হলো : Islami Bank is a financial institution whose statutes, rules and procedures expressly state its commitment to the principles of Islamic Shariah and to the banning of the receipt and payment of interest on any of its operations. যার বাংলা হলো: ইসলামী ব্যাংক এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যা তার উদ্দেশ্য, মূলনীতি ও কমর্পদ্ধতির সকল স্তরে ইসলামী শরিয়াহর সকল নীতিমালা মেনে চলতে বদ্ধপরিকর এবং তার কর্মকান্ডের সকল স্তরে সূদ বজর্ন করতে দৃড়প্রতিঞ্জ ।
ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ পদ্ধতি
বিনিয়োগ ও ঋণ : বিনিয়োগ ও ঋণ একই ধরনের শব্দ হলেও এর মধ্যে পাথর্ক্য রয়েছে । ইংরেজিতে Investment এর প্রতিশব্দ বিনিয়োগ। আর ইংরেজিতে Loan এর প্রতিশব্দ ঋণ । বিনিয়োগ ও ঋণ এই দুয়ের পাথর্ক্য অনেক । ঋণ এমন একটি লেনদেন, যাতে টাকা, দ্রব্য বা বস্তু ঋণ হিসাবে কাউকে প্রদান করা হলে, সময়মত ঋণগ্রহীতা ঠিক তাই ফেরত দিবে । ইসলামে এই ধরনের ঋণকে ‘করজে হাসানা’ বা উত্তম ঋণ বলা হয় । বতর্মানে প্রচলিত ব্যাংকগুলোতে যে ঋণ ব্যবস্থা চালু আছে তার সাথে অতিরিক্ত হিসাবে সূদ যুক্ত হওয়ায় ইসলামের দৃষ্টিতে তা কল্যাণকর না হয়ে হারাম বলে গন্য হয় । আর ঋণের উপর অতিরিক্ত যা আদায় করা হয়, তাকে সূদ বলা হয় । এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো সূদের জন্য ঋণ প্রদান করে থাকে । ঋন থেকে লাভ বা ক্ষতি হলে তার সাথে ব্যাংক জড়িত হয় না । ফলে ব্যাংকের কোন ঝুঁকি থাকে না। এজন্য ব্যাংকের কোন শ্রম বা মেধা ব্যয় করতে হয় না । অন্য দিকে ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থ দ্রব্য অথবা দ্রব্য অর্থ হিসাবে ব্যাংকের কাছে ফিরে আসে । এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ দাতার লাভ বা ক্ষতি হওয়ার সুযোগ থাকে । একচেটিয়া লাভ করার কোন সুযোগ থাকে না । এক্ষেত্রে বিনিয়োগ দাতাকে ঝুকিঁ বহন করতে হয় । বিনিয়োগ দাতাকে মেধা ও শ্র্র্র্রম ব্যবহার করতে হয় ।তাই বিনিয়োগ ও ঋণ বিপরীত বিষয় ।
বিনিয়োগের গুরুত্ব : প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে টিকে থাকা ও সফলতার জন্য মুনাফা লাভ করতে হয় । একটি ব্যাণিজ্যিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসাবে ইসলামী ব্যাংক গুলোকে অবশ্যই মুনাফা করতে হবে । অজির্ত এ মুনাফা থেকে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ব্যয় নিবার্হ এবং আনুষঙ্গিক খরচ মেটানো ছাড়া শেয়ারহোল্ডার, বিনিয়োগকারী ও আমানতকারীদের সন্তোষজনক হারে ডিভিডেন্ড ও মুনাফা প্রদান করতে হয় । স্বাভাবিকভাবে আমরা বুজতে পারি ইসলামী ব্যাংক যদি মুনাফা না করে, তা হলে আমানতকারীরা তাদের আমানত তুলে নেবে এবং শেয়ার হোল্ডারগন তাদের পুজিঁর উপর আস্থা হারাবেন । তাই মুনাফা অজর্ন করে ইসলামী ব্যাংকিং তথায় ইসলামী অথর্নীতিকে টিকে রাখার জন্য অবশ্যই মুনাফা করতে হবে ।
ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ পদ্ধতি : ইসলামী ব্যাংক প্রধানত তিনটি নীতির ভিত্তিতে অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে ।
১. ক্রয়-বিক্রয় নীতি (Bai-Mechanism) : এ নীতিতে ব্যাংক ঋণ দানের পরিবর্তে মক্বেল বা গ্রাহককে তার প্রয়োজনীয় পণ্য বা দ্রব্য ক্রয় করে এবং ক্রয়কৃত পণ্যের ক্রয়মূল্যের সাথে আনুষাঙ্গিক খরচ ও মুনাফা যুক্ত করে তার কাছে বিক্রয় করে থাকে । ক্রয়- বিক্রয় নীতির আওতায় বিনিয়োগ পদ্ধতি চারটি । যথা :
ক) বাই-মুরাবাহা
খ) বাই-মুয়াজ্জাল
গ) বাই-সালাম ও
ঘ) বাই-ইসতিসনা ।
ক) বাই-মুরাবাহা: আরবি শব্দ বাই ও রিবহুন থেকে বাই মুরাবাহা শব্দটি এসেছে।বাই অর্থ ক্রয়-বিক্রয় এবং রিবহুন অর্থ সম্মত লাভ । বাই-মুরাবাহা মানে লাভে ক্রয়-বিক্রয় ।অথ্যাৎ কোনো পণ্যসামগ্রী ক্রয়মূল্যের সাথে নিদির্ষ্ট পরিমান লাভের পরিমান যোগ করে বিক্রয় করাকে বাই মুরাবাহা বিনিয়োগ পদ্ধতি বলে । বাই-মুরাবাহা ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে এমন একটি চুক্তি, যাতে নগদে বা ভবিষ্যতের নির্ধারিত কোনো সময়ে একসাথে বা কিস্তিতে মূল্য পরিশোধের শর্তে উভয়ের সম্মতিক্রমে ক্রয়মূল্যের উপর নির্ধারিত মুনাফা ধাযর্করে শরিয়াহ অনুমোদিত পণ্যসামগ্রী বিক্রয় করা হয় ।
খ)বাই-মুয়াজ্জাল: আরবি শব্দ বাই ও আজল থেকে বাই-মুয়াজ্জাল শব্দটি এসেছে।বাই অর্থ ক্রয়-বিক্রয় এবং আজল অর্থ সময়। বাই-মুয়াজ্জাল মানে নির্ধারিত সময়ে দাম পরিশোধ করার শর্তে বাকিতে বিক্রয় । অথ্যাৎ বাই-মুয়াজ্জাল মানে সেই বিক্রয়, যেখানে কোনো নিদির্ষ্ঠ সময়ের পরে কোনো পন্য বা দ্রব্যের মূল্য পরিশোধ করা হবে । বাই-মুয়াজ্জাল ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে এমন একটি চুক্তি, যার আওতায় বিক্রেতার অনুরোধে ক্রেতা শরিয়াহ অনুমোদিত নিদির্ষ্ট পণ্য ক্রয় করে এবং ক্রেতা ভবিষ্যতের কোনো নিদির্ষ্ট সময়ের মধ্যে এককালীন বা কিস্তিতে পন্যের বিক্রয়মূল্য বিক্রেতাকে পরিশোধ করে।
গ) বাই-সালাম: বাই-সালাম আরবি শব্দ বাই ও সালাম থেকে এসেছে ।বাই অর্থ ক্রয়-বিক্রয় এবং সালাম অর্থ অগ্রিম বা আগাম । কাজেই বাই-সালাম বলতে পণ্যের আগাম ক্রয়-বিক্রয়কে বুঝায়।বাই-সালাম এমন একটি ব্যবসায়িক চুক্তি যার আওতায় আগামী কোনো নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য সরবরাহের শর্তে ব্যাংক মালের দাম আগাম পরিশোধ করে ।
ঘ) বাই-ইসতিসনা: আরবি সানা শব্দ থেকে ইসতিসনা শব্দের উদ্ভব।সানা শব্দের অর্থে শিল্পী । তা ছাড়া সানা বলতে তৈরি করা, নির্মান করা, উৎপাদন করা, প্রস্তুত করা। এটা আদেশের ভিত্তিতে পণ্য ক্রয়ের পদ্ধতি, তাই আদেশ গ্রহণ করে পণ্য তৈরি অথবা সংগ্রহ করে মাল বানিয়ে বিক্রয় করার নাম বাই-ইসতিসনা। অন্যভাবে বলতে গেলে, পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কোনো জিনিস নির্মাণ বা উৎপাদন করে দেয়ার জন্য কোনো দক্ষ ও অভিঞ্জ শ্রমিকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়াকে বাই-ইসতিসনা বলে।
২. অংশীদারি নীতি(Share-Mechanism) : এ নীতিতে ইসলামী ব্যাংক লাভের উদ্দেশ্যে কোনো ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোক্তাকে পুজিঁর যোগান দেয় এবং কারবারের লাভ-ক্ষতিতে অংশ নেয় । এ নীতির আওতায় বিনিয়োগপদ্ধতি হলো দু্টি । যথা:
ক) মুদারাবা ও
খ) মুশারাকা
ক)মুদারাবা: আরবি শব্দ দারবুন থেকে মুদারাবা শব্দের উৎপত্তি।মুদারাবা এমন একটি বিনিয়োগ পদ্ধতি যেখানে দুটি পক্ষ থাকে । এক পক্ষ পুজিঁর যোগান দেয় এবং অপর পক্ষ পুজিঁর ব্যবহার করে । অতএব যে কারবারে এক পক্ষ মূলধন যোগান দেয় এবং দ্বিতীয় পক্ষ শ্রম, মেধা ও সময় ব্যয় করে কারবার পরিচালনা করে, তাকে মুদারাবা বলে। যিনি মূলধন যোগান দেন তাকে সাহিবুল মাল এবং যিনি বিনিয়োগ গ্রহণ করেন তাকে মুদারিব বলে । মুদারাবা কারবারে প্রকৃত লাভ হলে তা সাহিবুল মাল ও মুদারিব চুক্তি অনুযায়ী ভাগ করে নেবেন এবং প্রকৃত লোকসান হলে তা সাহিবুল মাল একাই বহন করবেন । লোকসানের বেলায় সাহিবুল মাল সবটুকু লোকসান বহন করলেও মুদারিব তার শ্রম ও তৎপরতার কোনো পারিশ্রমিক না পাওয়াটাই তার লোকসান ।
খ)মুশরাকা: আরবি শিরকাত থেকে মুশারাক শব্দটি এসেছে। শিরকাত অর্ শরিক হওয়া বা অংশীদার হওয়া । তাই শাব্দিক দিক থেকে মুশারাকা অর্থ অংশীদারিত্ব। মুশারাকা বলতে এমন একটি অংশীদারি কারবারকে বুঝায়, যেখানে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান একত্রিত হয়ে লাভের উদ্দেশ্যে কারবার পরিচালনা করে এবং কারবারের লাভ-ক্ষতিতে অংশগ্রহণ করে। কারবারে লাভ হলে অংশীদারগণ পূব নির্ধারিত হারে তা ভাগ করে নেয় এবং লোকসান হলে নিজ নিজ পুজিঁ অনুসারে তা বহন করে ।
৩) ভাড়াদান নীতি(Lease-Mechanism):এ নীতিতে ইসলামী ব্যাংক তার মালিকানাধীন কোনো সম্পদ গ্রাহকের কাছে নিদির্ষ্ট সময়ের জন্য ভাড়া দেয় । অথবা গ্রাহকের ফরমায়েশ অনুযায়ী কোনো সম্পদ যেমন, গাড়ী নিজ নামে ক্রয় করে তা গ্রাহকের নিকট ভাড়ায় খাটায় ।এই চুক্তিকে “হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাত অাল মিল্ক” বলা হয় ।এটা হচ্ছে ক্রমহ্রাসমান অংশীদারিত্ব বিনিয়োগ পদ্ধতি ।
হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাত আল মিল্ক একটি বিশেষ ধরনের চুক্তি । মূলত এই বিনিয়োগ পদ্ধতিতে তিনটি চুক্তির সম্মেলন ঘটে ।যথা:
১. শিরকাত ২. ইজারা ৩. বিক্রয়
হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাত আল মিল্ক চুক্তির আওতায় ব্যাংক ও গ্রাহক যৌথ নামে কোন শরীয়াহ সম্মত স্থায়ী সম্পদ যা কমপক্ষে কয়েক বার ব্যবহার করা যায়, এই ধরনের সম্পদ ক্রয় করে গ্রাকের নিকট ভাড়া ও মূল্য পরিশোধ সাপেক্ষে গ্রাহক ব্যাংকের অংশের মালিকানা একসাথে বা কিস্তি আকারে অর্জন করতে পারে ।