করোনাভাইরাসের কারণে আগামী ৩ অর্থবছরে (২০২০-২৩) রাজস্ব আহরণে বড় ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়বে। পাশাপাশি বড় ধরনের সংস্কারসহ জরুরি সেবা নিশ্চিত করতে অস্বাভাবিক ব্যয় বাড়বে ‘স্বাস্থ্য খাতে’। আর বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নানা প্যাকেজ, নিম্নআয়ের মানুষের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে আগামীতে প্রণোদনায় ব্যয় হবে বড় অঙ্কের টাকা।

গোটা পরিস্থিতি সামাল দিতে নেয়া হয়েছে মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা। এটি বাস্তবায়নে নেয়া হবে ৫ লাখ ৭১ হাজার ৪০০ (প্রায় পৌনে ৬ লাখ) কোটি টাকার ঋণ। যা প্রস্তাবিত বাজেটের চেয়েও ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে বিদেশ থেকে ঋণ নেবে ২ লাখ ৭১ হাজার ৯শ’ কোটি টাকা এবং দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে নেয়া হবে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

অর্থায়ন প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেটত্তোর সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে রক্ষা করাই আমাদের চিন্তা। মানুষকে বাঁচাতে হবে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে গ্রামের অর্থনীতিসহ সামষ্টিক অর্থনীতি চাঙ্গা করতে হবে। এটি করতে প্রয়োজনে টাকা সংগ্রহের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে যাব। বিদেশে গিয়েও টাকা সংগ্রহ করব।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবিএম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সরকার একদিকে বড় অঙ্কের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করছে। অপরদিকে বড় অঙ্কের ঋণ নিচ্ছে রাজস্ব আহরণ কম হবে বলে। এটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ কথা। আমি মনে করি, রফতানি আয় ও ঋণের অনুপাত বিবেচনা করলে বিদেশি ঋণ নেয়ার সুযোগ আমাদের আছে। এতে খুব বেশি সমস্যা হবে না। তবে চেষ্টা করতে হবে স্বল্প সুদে ঋণ নেয়ার। কারণ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার বাংলাদেশ এখন স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা হারাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ কম নেয়া ভালো হবে। কারণ এখনই বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি কম। এ খাত থেকে ঋণ বেশি নিলে বেসরকারি বিনিয়োগে ভাটা পড়বে। এতে কর্মসংস্থানও কম হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের পূর্বাভাসে উল্লেখ করা হয়, বিগত ৫ বছর রাজস্ব আদায় সঠিকভাবে হওয়ায় সরকারের ঋণ গ্রহণ পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে রাজস্ব আহরণে বিরূপ প্রভাব পড়বে। সঙ্গে সঙ্গে জরুরি স্বাস্থ্য সেবা ও প্রণোদনা কর্মসূচিতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হবে। এতে মধ্যমেয়াদি বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। সেখানে আরও বলা হয়, করোনাভাইরাসের ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি দ্রুত পুনরুদ্ধার করতে ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এর ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ফিরে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যমেয়াদি অর্থনৈতিক কাঠামো প্রতিবেদনে বলা হয়, কোভিড-১৯ মহামারীজনিত ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে সরকারের অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন। ২০২০-২১ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত সরকার ঘাটতি অর্থায়নে ৫ লাখ ৭১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে বিদেশ থেকে ঋণ নেয়া হবে ৮৮ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা ও ব্যাংকিং খাত থেকে নেয়া হবে ৮৫ হাজার কোটি টাকা। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশ থেকে ঋণ নেয়া হবে ৮৬ হাজার কোটি টাকা এবং ব্যাংকিং খাত থেকে নেয়া হবে ৮০ হাজার ২শ’ কোটি টাকা এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের বিদেশ থেকে ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে ৯৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা এবং ব্যাংক থেকে নেয়া হবে ৯৪ হাজার ৭শ’ কোটি টাকা।

ঋণ গ্রহণ প্রসঙ্গে মধ্যমেয়াদি কাঠামোতে বলা হয়, করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি দ্রুত পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এসব প্যাকেজ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের নতুন উৎস সন্ধান করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক, (এআইআইবি), জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থাসহ (জাইকা) বড় উন্নয়ন অংশীদারের কাছ থেকে বাজেট ভারসাম্য সহায়তার সাড়া পাওয়া গেছে। এডিবি ইতোমধ্যে ৪ হাজার ২৫০ কোটি টাকা বা ৫০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড় করেছে। এছাড়া বিশ্বব্যাংক ও এআইআইবি ৬ হাজার ২০৫ কোটি টাকা বা ৭৩ কোটি মার্কিন ডলার ছাড় করেছে। সরকার আশা করছে ২০২০-২১ অর্থবছরে উন্নয়ন সংস্থাগুলোর কাছ থেকে অতিরিক্ত ১৭ হাজার কোটি টাকা বা ২শ’ কোটি ডলার ঋণ পাবে। নতুন বছরে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ডিজিপির শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বেশি পাবে অর্থ মন্ত্রণালয় প্রত্যাশা করছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে একদিকে বিভিন্ন প্যাকেজ বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রসারণমূলক আর্থিক নীতি গ্রহণ করেছে। এতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও গতি সঞ্চার হবে। বিদেশি ঋণ নিয়ে অভ্যন্তরীণ সংস্কার করা হবে। এ ঋণের সুদহার স্বল্প আছে। ফলে এ ঋণ ভবিষ্যতে জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে গতিশীলতা তৈরি করবে। ফলে জিডিপির অনুপাতে ঋণ অনুপাত সামান্য বেশি হলেও মোটেই উদ্বেগের কারণ হবে না। ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান যৌক্তিকভাবে নিম্নমুখী আছে। আর ঋণ পরিশোধের সক্ষমতার নজিরও আছে।

বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ বাংলাদেশের ২০১৯ সালের বৈদেশিক ঋণ নিয়ে একটি বিশ্লেষণ করেছে। সেখানে বলা হয় রফতানি আয়ের ২১ শতাংশ এবং রাজস্ব আহরণের ২৩ শতাংশের সমান বহির্বিশ্ব থেকে বাংলাদেশ ঋণ নিয়েছে। এটি বৈদেশিক ঋণের স্থিতি প্রান্তিক স্তরের চেয়ে অনেক কম এবং সরকারের ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা আছে। ( সূত্র : যুগান্তর )

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *